বার্সেলোনার হৃদয়ে এখন এক ভিন্ন সুর। তরুণ প্রতিভার ঝলকানিতে যখন ফুটবল বিশ্ব মুগ্ধ, তখনই প্রশ্ন উঠেছে লামিনে ইয়ামালের চুক্তি নিয়ে। বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট জোয়ান লাপোর্তা স্বয়ং এই বিষয়টিকে অভিহিত করেছেন এক ‘বিশেষ ঘটনা’ হিসেবে। যেন এক উদীয়মান নক্ষত্র তার নিজস্ব কক্ষপথ ছাড়িয়ে নতুন এক দিগন্তে পা রাখছে, আর তার গতির সাথে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে পুরনো নিয়মকানুন।
২০২৬ সালের গ্রীষ্মে যার বর্তমান চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে, সেই ইয়ামালকে ঘিরে জমে উঠেছে জল্পনা। গত ২০২৩ সালে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করার পর থেকে সে নিজেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা তরুণ ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার পায়ে যেন লেগে আছে যাদু, প্রতি ম্যাচে সে প্রমাণ করছে নিজের অদম্য ক্ষমতা। স্পেনের হয়ে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয়, টুর্নামেন্টের সেরা তরুণ খেলোয়াড়, সেরা গোল এবং সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের পুরস্কার – সবকিছুই যেন তার প্রতিভার স্বাক্ষর। বার্সেলোনার হয়ে লা লিগা, কোপা দেল রে এবং স্প্যানিশ সুপারকোপা জয়ের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে তাদের অগ্রযাত্রায়ও তার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বার্সেলোনার হয়ে অভিষেক, সে যেন সময়ের গতির চেয়েও দ্রুত ছুটছে।
‘এক বিশেষ ক্ষেত্র, এক অন্যরকম দ্যুতি’
লাপোর্তা যখন ইয়ামালের চুক্তি নবায়নের বিষয়ে কথা বলেন, তার কণ্ঠে ছিল এক মিশ্র সুর। তিনি বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে এবং ভিত্তি বেশ মজবুত। কিন্তু এখনও স্বাক্ষর বাকি, তাই পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি, যদিও সব ইঙ্গিতই ক্লাবের জন্য একটি শুভ ফলাফলের দিকে।’
এই কথাগুলো যেন এক অনিশ্চিত কবিতার চরণ, যেখানে প্রতিটি শব্দে লুকানো আছে প্রত্যাশা আর চ্যালেঞ্জের দোলাচল। ইয়ামালকে ‘এক দারুণ মানুষ, বার্সার এক বড় ভক্ত’ হিসেবে উল্লেখ করে লাপোর্তা যেন বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই সম্পর্কটা শুধু কাগজের চুক্তিতে বাঁধা নয়, বরং হৃদয়ের এক গভীর টান।
লাপোর্তা অকপটে স্বীকার করেছেন যে, ইয়ামালের বেতন তার গুরুত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত এবং তার বয়স কোনো বাধা হওয়া উচিত নয়। লাপোর্তা কিছু কথা যোগ করেছেন এভাবে ‘সে একটি বিশেষ ক্ষেত্র, সাধারণের বাইরে, এবং তার জন্য বিশেষ আচরণ প্রয়োজন। সব খেলোয়াড়ের একটি নির্দিষ্ট অগ্রগতি থাকে, কিন্তু লামিনের মতো একজন, যে ব্যতিক্রমী উপায়ে বিস্ফোরিত হয়েছে, তাকেও আমাদের বিশেষ উপায়ে সমাধান করতে হবে।’ এই কথাগুলো যেন এক শিল্পীর তুলির আঁচড়, যা ফুটিয়ে তুলছে এক অপ্রচলিত প্রতিভার বিরল চিত্র।
২০২৩ সালের অক্টোবরে যখন ইয়ামাল তার বর্তমান চুক্তি স্বাক্ষর করে, তখন তার বয়স ১৬ বছর। সেই চুক্তিতে কাগজে-কলমে ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদ ছিল। কিন্তু সেই আলোচনার সময়ই বার্সেলোনা এবং ইয়ামালের পক্ষ থেকে একটি নতুন চুক্তির ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল, যা ইয়ামাল ১৮ বছর বয়সে পা রাখলেই স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। সেই নতুন চুক্তিতে বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি বহু বছরের মেয়াদ বাড়ানোর কথাও ছিল।
কিন্তু আবারও, ইয়ামাল তার চারপাশে থাকা সমস্ত প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেছে। ২০২৩ সালে যা নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছিল, তা আর বাস্তবতার সাথে মেলে না – ইয়ামাল এখন দলের সেরা ফুটবলার এবং ব্যালন ডি’অর-এর সম্ভাব্য প্রার্থী। এই বাস্তবতা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষই স্বীকার করেছে এবং এই কারণেই গত কয়েক মাস ধরে বার্সেলোনা এবং ইয়ামালের দল তার পরবর্তী চুক্তির শর্তাবলী নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সমাধানটি এত সহজ নাও হতে পারে এবং এটি বার্সেলোনার মধ্যে এক বিতর্ক তৈরি করেছে। এটা স্পষ্ট যে, বার্সেলোনা ইয়ামালকে উপযুক্ত চুক্তিতে ধরে রাখতে সবকিছু করবে এবং ইয়ামাল নিজেও খোলাখুলিভাবে বলেছে যে, সে অদূর ভবিষ্যতে এখানেই থাকতে চায়।
কিন্তু একজন ১৭ বছর বয়সী কিশোর কি সত্যিই বিশ্বমানের এবং অভিজ্ঞ তারকাদের পূর্ণ একটি ক্লাবের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী হতে পারে? যদি এর চেয়েও বেশি দূর ভাবা যায় যে: ইয়ামাল যদি এই বয়সে এই অবস্থানে পৌঁছায়, তাহলে সে যখন ২৪ বছর বয়সে পৌঁছাবে এবং বর্তমানের মতো গতি বজায় রাখবে, তখন বার্সেলোনা তাকে কী দিতে পারবে?
এই প্রশ্নগুলো বার্সেলোনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দফতরে এবং ড্রেসিংরুমের কাছাকাছি থাকা প্রতিটি ফুটবল এজেন্টের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু ইয়ামাল এমন এক অনন্য ঘটনা যে, ক্লাব তাকে অনন্য আচার-ব্যবহার তার প্রাপ্য দিতে বাধ্য। টিভি৩-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লাপোর্তার কথাগুলো ক্লাবের অবস্থানকে প্রকাশ করেছে, যা বিশ্ব ফুটবলে ইয়ামালের নতুন অবস্থানকে স্বীকার করে। আগামী মাসগুলোতে এটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার মতো একটি বিষয়।
জার্সি নম্বর বদলের ফিসফাস
গুঞ্জন উঠেছে, ইয়ামাল আগামী মৌসুমে বার্সেলোনার আইকনিক ১০ নম্বর জার্সি পরবে। কিন্তু এই মুহূর্তে জার্সিটি আনসু ফাতির দখলে, যার চুক্তি ২০২৭ সাল পর্যন্ত রয়েছে। লিওনেল মেসি ক্লাব ছাড়ার পর (২০২১ সালের গ্রীষ্মে) ফাতিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ১০ নম্বর জার্সি পরেছেন এবং ২০২২-২৩ মৌসুমে তিনি ইংলিশ ক্লাব ব্রাইটন অ্যান্ড হোভ অ্যালবিয়নে লোনে থাকাকালীন এটি অব্যবহৃত ছিল। এরপর সে এই মৌসুমে আবার সেটি গায়ে তুলেছে।
১০ নম্বর জার্সির বিষয়ে লাপোর্তা বলেন, ‘এটি অভ্যন্তরীণভাবে আলোচনা করা হবে। লামিনে গত গ্রীষ্মে ১৯ নম্বর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং এখন আমরা দেখব আমাদের নম্বরের বন্টন কেমন হবে।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘অবশ্যই, লামিনে একজন ভিন্ন খেলোয়াড়ে বিকশিত হয়েছে, কিন্তু এটি একটি দলগত খেলা। লামিনের সম্পর্কে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগা একটি বিষয় হলো, তার ব্যক্তিগত প্রতিভা ছাড়াও, সে দলগত খেলার সাথে খুব ভালোভাবে জড়িত। সে এই বিষয়ে সচেতন।’
এই কথাগুলো যেন এক নীরব প্রতিশ্রুতি, যেখানে সময়ের সাথে সাথে এক তরুণ প্রতিভা তার নিজস্ব স্থান তৈরি করে নিচ্ছে, আর বার্সেলোনাও তার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই গল্প যেন এক অদম্য তারুণ্যের জয়, যা শুধু মাঠের খেলাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ক্লাবের অন্দরেও তৈরি করেছে এক নতুন দিগন্ত।
তথ্য সূত্র: দ্য অ্যাথলেটিক, মার্কা, গোল ডটকম, টিভি-৩
বিটি/ আরকে
Tags: ইয়ামাল, বার্সেলোনা