রাজস্ব খাতে সংস্কার নিয়ে সরকারের সঙ্গে কর্মকর্তাদের চলমান বিরোধ নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ফলে পুরো রাজস্ব প্রশাসন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এই অচলাবস্থা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা, অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন—দীর্ঘমেয়াদি ও তাৎক্ষণিকভাবে এই অচলাবস্থা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাকে গুরুতরভাবে ব্যাহত করতে পারে। রাজস্ব ভবন কার্যত অবরুদ্ধ, দেশের বিভিন্ন কর কার্যালয় অচল, আর দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ, বিভ্রান্তিকর তথ্য ও পাল্টাপাল্টি অভিযোগে জড়িয়েছে।
২০২৫ সালের ১ জুলাই শুরু হতে যাওয়া নতুন অর্থবছরের এমন অচলাবস্থা রাজস্ব সংগ্রহকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও এর মাঠ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে তারা এফইকে জানান, ঈদের ছুটির পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হতে শুরু করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি ছয়জন আন্দোলনরত কর্মকর্তার বদলি আদেশ, এনবিআরের কনফারেন্স রুম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মোতায়েন আবারও উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাজস্ব বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “এটা এখন এক ধরনের ‘ইগো-চালিত’ অচলাবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের কর্মকর্তারা পরস্পরকে দোষারোপ করছে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “এ ধরনের পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সমাধান করা যাবে না।”
অর্থনীতিবিদরা শুল্ক ও কর কার্যক্রমে এই স্থবিরতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে শনিবার বন্দর কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ায় রপ্তানি আয়ও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
পলিসি ডায়ালগ সেন্টারের সম্মানিত ব্যক্তি অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সরকারকে অবিলম্বে এই সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “ব্যবসা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ—সব কিছুতেই দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। এটা এখন জাতীয় অগ্রাধিকারের বিষয়।”
তিনি মনে করিয়ে দেন, “এনবিআর অর্থনীতির স্নায়ুকেন্দ্র—দেশের রাজস্ব আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ এখান থেকেই আসে। রাজস্ব সংগ্রহে ধাক্কা মানে পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোতে ধাক্কা।”
তাঁর মতে, এনবিআর পুনর্গঠন ও সংস্কার পরিকল্পনা সরকারকে নতুনভাবে ভাবতে হবে।
র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ড. আবু ইউসুফ বলেন, “পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। এখনই তা প্রশমিত করা দরকার। উভয় পক্ষকে নিজেদের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে সমঝোতায় আসতে হবে।”
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, “রপ্তানি বৃদ্ধি, মুদ্রা স্থিতিশীলতা, রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়া, পেমেন্ট ব্যালেন্সে উন্নতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ—সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু এই অস্থিরতা সব কিছু ভণ্ডুল করে দিতে পারে।”
তিনি সতর্ক করেন, “কর্মবিরতি ও বন্দর কার্যক্রমে বিঘ্ন অব্যাহত থাকলে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দীর্ঘ সময় পিছিয়ে যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় অভ্যন্তরীণ রাজস্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। দেরিতে হলেও এখন এই সংকট অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রস্তুতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।”
তাই ড. রিয়াজ উভয় পক্ষকে অহংবোধ ও শর্ত থেকে সরে এসে আলোচনায় ফিরতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভিভাবক হিসেবে অর্থ উপদেষ্টার উচিত সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসা। এটা কোনো অমীমাংসিত সংকট নয়।”
“কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে টার্গেট করা নয়—জাতীয় স্বার্থই যেন সবার আগে আসে।”
বিটি/ আরকে
Tags: আমদানি, এনবিআর, রপ্তানি, রাজস্ব আদায়