যখন কোনো পোপ প্রয়াত হন বা পদত্যাগ করেন, তখন বিশ্বের কার্ডিনালগণ একজন উত্তরসূরি নির্বাচনের জন্য রোমে একত্রিত হন। কিন্তু একজন পোপ আসলে কী করেন?
এখানে বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক চার্চের প্রধান পোপের মূল দায়িত্বগুলোর একটি বিবরণ দেখে নেওয়া যাক।
ক্যাথলিক নেতা
‘পোপ’ (Pope) শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘পাপ্পাস’ (pappas) থেকে এসেছে, যার অর্থ “পিতা, ধর্মপ্রধান”। একারণেই বিশ্বাসীরা তাকে ‘পবিত্র পিতা’ (Holy Father) বলে সম্বোধন করেন।
তাঁকে সেন্ট পিটারের উত্তরসূরি হিসেবে গণ্য করা হয়, যাঁকে যিশু খ্রিস্ট চার্চ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়।বর্তমানে সেই বিশ্বাস পোপকে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ১৪০ কোটি ক্যাথলিকের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক করে তুলেছে।
তাঁর ভূমিকা হলো খ্রিস্টীয় বিশ্বাসকে রক্ষা করা, ব্যাখ্যা করা এবং শিক্ষা দেওয়া, পাশাপাশি ক্যাথলিক চার্চের ঐক্য নিশ্চিত করা।
রাষ্ট্রপ্রধান
পোপ একইসাথে রাষ্ট্রপ্রধান এবং ভ্যাটিকান সিটি রাষ্ট্রের শাসক। ইতালির রাজধানী রোমের অভ্যন্তরে অবস্থিত মাত্র ৪৪ হেক্টর আয়তনের এই রাষ্ট্রটি বিশ্বের ক্ষুদ্রতম।
তিনি ভ্যাটিকানের কর্মচারী নিয়োগ ও বরখাস্ত থেকে শুরু করে এর বিশাল সম্পত্তি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পর্যন্ত সমস্ত ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী, যদিও তিনি এর বেশিরভাগ কাজ ঊর্ধ্বতন যাজকদের উপর অর্পণ করেন।
পোপের নিজস্ব কূটনীতিক রয়েছেন, তবে তিনি প্রায়শই ভ্যাটিকানে বিশ্ব নেতাদের সাথে মিলিত হন, যা ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার হিসেবে পরিচিত।
নৈতিক পথপ্রদর্শক
বিশ্বের ক্যাথলিক জনগোষ্ঠীর বাইরেও পোপের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে; তিনি বিশ্ব মঞ্চে একজন অগ্রগণ্য নৈতিক কণ্ঠস্বর।
অনেক অ-ক্যাথলিক নেতাও ভ্যাটিকানে তাঁর সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন এবং তাঁর ঘোষণাগুলো প্রায়শই বহু নির্বাচিত রাজনীতিবিদের বক্তব্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে।
জাতিসংঘে ভ্যাটিকানের পর্যবেক্ষক সদস্যের মর্যাদা রয়েছে এবং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে প্রায়শই এটিকে নিরপেক্ষ পক্ষ হিসেবে আহ্বান জানানো হয়।
মতবাদ ও শিক্ষা
পোপ তাঁর ধর্মোপদেশ এবং লিখিত বার্তার মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবন (যেমন পরচর্চা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ) থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদিক বিষয় পর্যন্ত নানা বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন।
তিনি বেশ কয়েকটি ‘এনসাইক্লিকাল’ প্রকাশ করেন – যা পোপ কর্তৃক বিশ্বব্যাপী চার্চের উদ্দেশ্যে লেখা খোলা চিঠি। এগুলোর বিষয়বস্তুর মধ্যে সামাজিক বন্ধুত্ব বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকে।
অন্যান্য আনুষ্ঠানিক লেখার মধ্যে রয়েছে ‘অ্যাপোস্টোলিক এক্সহোরটেশন’, যা শিক্ষামূলক নথি, এবং ‘মোতু প্রপ্রিও’, যার অর্থ “স্বতঃপ্রণোদিতভাবে” এবং এটি পোপের নিজ উদ্যোগে করা কোনো আইনি পরিবর্তন।
উদাহরণস্বরূপ, পোপ ফ্রান্সিস তাঁর দায়িত্বে থাকাকালীন সমলিঙ্গ যুগলদের আশীর্বাদ দেওয়ার পথ খুলে দিয়েছেন, ঐতিহ্যবাহী ল্যাটিন ম্যাসের ব্যবহার সীমিত করেছেন এবং যাজকদের দ্বারা শিশুদের যৌন নির্যাতন মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
নিয়োগ
পোপ বিশ্বজুড়ে ক্যাথলিক ডায়োসিসগুলোর নেতৃত্বদানকারী প্রায় ৩,০০০ বিশপের নিয়োগ অনুমোদন করেন এবং কার্ডিনালদেরও নিয়োগ দেন।
কার্ডিনালরা, যাঁদের কখনও কখনও চার্চের রাজপুত্র বলা হয়, তাঁরা হলেন সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন যাজক এবং যাঁদের বয়স ৮০ বছরের কম, তাঁরা নতুন পোপ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন।
কোনো ব্যক্তিকে ‘পরম পূজনীয়’ বা ‘সন্ত’ পদে উন্নীত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও পোপের হাতে থাকে, যা অলৌকিক ঘটনা এবং সদ্গুণের ভিত্তিতে পরিচালিত তদন্তের পর নেওয়া হয়।
তিনি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য সিনড– অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় সমাবেশ – আহ্বান করার ক্ষমতা রাখেন। পোপ ফ্রান্সিস প্রথমবারের মতো এই সিনড সাধারণ বিশ্বাসীদের জন্য উন্মুক্ত করেছিলেন।
ভ্রমণ
পোপ বিশ্বজুড়ে বিশ্বাসীদের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য ভ্রমণ করেন। পোপ দ্বিতীয় জন পল সবচেয়ে বেশি অ্যাপোস্টোলিক ভ্রমণ করেছিলেন; পোপ হিসেবে ২৬ বছরে তিনি ১০৪ বার বিদেশ সফর করেন।
পোপ ফ্রান্সিস ৪৭টি সফর করেছেন এবং এই সফরগুলোকে তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা অভিবাসন অথবা আন্তঃধর্মীয় সংলাপের মতো বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করার জন্য ব্যবহার করেছেন।
রোমের বিশপ
রোমের বিশপ হিসেবে পোপ তাঁর নিজস্ব ডায়োসিস (ধর্মীয় এলাকা) পরিচালনার জন্য দায়িত্ব । তবে তাঁর সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে এই দায়িত্বটি বাস্তবে একজন ভিকার জেনারেলের উপর অর্পণ করা হয়।
তা সত্ত্বেও, পোপ স্থানীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেন এবং নিয়মিতভাবে রোমের চার্চগুলোতে বিভিন্ন উদযাপন বা শহরের অন্যান্য প্রতীকী স্থান পরিদর্শন করেন।
সূত্র: এএফপি
বিটি/ আরকে