মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম মাসে আমেরিকার গঠিত ৮০ বছরের বিশ্বব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে অভূতপূর্ব এক মিশনে নেমেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তন
ট্রাম্প হঠাৎ করেই পশ্চিমা জোটের দীর্ঘদিনের নীতিকে উল্টে দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও শীতল যুদ্ধের পর পশ্চিমা নেতৃত্বের গুরুত্ব কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হলেও, কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেই এটি কুড়াল হাতে ভাঙতে আসবেন, তা কেউ কল্পনা করেননি।
গত বছরের নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়লাভের পর পশ্চিমা কূটনীতিকরা মনে করেছিলেন যে তাঁরা প্রথম মেয়াদের মতোই ট্রাম্পকে সামলাতে পারবেন। কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ার পর ইউরোপীয় নেতারা যে চরম বিপদের সংকেত অনুভব করছেন, তা তাদের প্যারিসের জরুরি বৈঠকেই বোঝা যায়।
ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়ার প্রতি সমর্থন
ট্রাম্প এখন ইউক্রেন যুদ্ধের নীতিতে আমূল পরিবর্তন এনে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বক্তব্য অনুসরণ করছেন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা করছেন।
উপ-রাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স মিউনিখে গিয়ে ইউরোপীয় নেতাদের “স্বৈরাচারী” বলে আক্রমণ করেন এবং জার্মানির রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলার আহ্বান জানান। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদের নিতে বলেছেন, যা ন্যাটোর মৌলিক নীতির পরিপন্থী।
বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার নতুন ভূমিকা
ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি পরিবর্তনের পেছনে কেবল তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারাই নয়, বরং বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনও ভূমিকা রাখছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের শক্তিশালী দেশ, তবে তাদের একক কর্তৃত্ব কমছে। বিশেষ করে চীনের মতো শক্তিগুলোকে আর নিজেদের নিয়ম মানতে বাধ্য করতে পারছে না।
ট্রাম্প প্রশাসন এখন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিয়ম ভঙ্গ করতে উন্মুখ। এমনকি কানাডাকে সংযুক্ত করার (অ্যানেক্স) হুমকিও দিচ্ছেন ট্রাম্প। শুধু তাই নয়, তাঁর সরকার পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী চরমপন্থার উত্থান ঘটাতে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে।
ভ্যান্স ইউরোপের সরকারগুলোর অভ্যন্তরীণ নীতিগুলোকে চীনের বা রাশিয়ার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর বলে অভিহিত করেছেন এবং জার্মানির উগ্র-ডানপন্থী দল আফডি (এএফডি)-র সঙ্গে দেখা করেছেন। ট্রাম্প চান ইউরোপে তাঁর নিজস্ব “মেক ইউরোপ গ্রেট এগেইন (এমইজিএ)” আন্দোলন গড়ে তুলতে, যা বর্তমান মধ্যপন্থী নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাবে।
ইউরোপের সামনে চ্যালেঞ্জ
যুক্তরাষ্ট্র এখন শত্রুতাপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হচ্ছে—এই বাস্তবতায় ইউরোপ কী করতে পারে? ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বহুদিন ধরেই সতর্ক করছেন যে আমেরিকা আর আগের মতো নির্ভরযোগ্য অংশীদার নেই। এখন ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
তবে এটি ইউরোপের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত হবে, কারণ অনেক দেশ ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে এবং জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি বজায় রাখতে লড়াই করছে। এছাড়া, ইউরোপের সব দেশ একসঙ্গে আমেরিকার বিকল্প পথ বেছে নেবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার হুমকি ভালোভাবেই বোঝে, কিন্তু পশ্চিম ইউরোপের ছোট দেশগুলোর কাছে এটি অতটা তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
উদ্বেগের আরও একটি কারণ হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে এমন নেতাও আছেন, যারা পশ্চিমা জোটকে দুর্বল করতে ট্রাম্প ও পুতিনের সঙ্গে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান এর একটি বড় উদাহরণ।
পরবর্তী সপ্তাহে নজর রাখার বিষয়
আগামী সপ্তাহে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইউক্রেন যুদ্ধই প্রধান আলোচনার বিষয় হবে।
ম্যাক্রোঁর মার্কিন সফর: ফরাসি প্রেসিডেন্ট সোমবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তাঁর লক্ষ্য হবে ট্রাম্পকে পুতিনের প্রতি দুর্বল মনোভাব ত্যাগ করতে রাজি করানো। ম্যাক্রোঁ ইতিমধ্যেই বলেছেন, “আমি ট্রাম্পকে বলব, ‘পুতিনের সামনে দুর্বল হওয়া তোমার চরিত্র নয়, এটা তোমার ট্রেডমার্ক নয়’।”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের সফর: বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার হোয়াইট হাউসে আসবেন। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে নেই, কিন্তু তারা ইউরোপের সঙ্গে মিল রেখে আমেরিকাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।
ন্যাটো ও প্রতিরক্ষা ব্যয়: ব্রিটেন ও ফ্রান্স তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেবে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। কারণ, ইউক্রেনের যেকোনো ভবিষ্যৎ শান্তিচুক্তিতে পশ্চিমা সেনাদের তদারকি করতে হলে মার্কিন সামরিক সহায়তা লাগবে।
মাত্র ৩১ দিনের মধ্যে ট্রাম্প বিশ্ব রাজনীতির চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। তিনি ন্যাটোকে দুর্বল করেছেন, ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন এবং ইউরোপের ডানপন্থীদের উত্সাহিত করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপ কি এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে, নাকি আমেরিকার ছায়া থেকে বের হয়ে একটি স্বাধীন শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে?